মরিচ চাষের পদ্ধতি ও অধিক ফলনের কলা কৌশল। - Agro Pro

মরিচ চাষের পদ্ধতি ও অধিক ফলনের কলা কৌশল।

মরিচ চাষ


মরিচ চাষ পদ্ধতিঃ

মরিচ আমাদের দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। মরিচকে ইংরেজিতে চিলি বলা হয়। মরিচ নিত্য ব্যবহৃত মশলা যা তরকারিকে সুস্বাদু করতে বিরাট ভুমিকা রাখে। বাংলাদেরশের প্রায় সব অঞ্চলে মরিচের চাষাবাদ করা হয়। তবে চরাঞ্চালে মরিচের উৎপাদন সবথেকে বেশি হয়ে থাকে।

আমাদের দেশের অনেক জেলাতেই বাণিজ্যিক ভাবে মরিচ চাষ করা হয়। মরিচ এর বাজার মূল্যও অনেক। মরিচ চাষের মাধ্যমে আমরা নারী/পুরুষ উভয়ে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যসস্থা নিজেরাই করে নিতে পারি। তার জন্য মরিচ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে আমাদের জানতে হবে।


মাটি ও জলবায়ুঃ

মরিচ চাষের জন্য এমন জমি নির্বাচন করতে হবে যে জমিতে বৃষ্টির পানি জমে থাকে না এবং বর্ষার পানি উঠে না এমন উচু জমি। জমিতে পানি নিষ্কাশনের সু ব্যবস্থা থাকতে হবে। যে স্থানে প্রচুর রোদ ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে।

যে মাটিতে বেশি অম্ল আছে সে মাটি ছাড়া সব ধরনের মাটিতে মরিচ জন্মে থাকে। মরিচ চাষের জন্য দো-আশঁ মাটি সব থেকে উপযোগী। মরিচ চাষের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা হলো ৩৫ থেকে ৪৫ ডিঃ সেঃ।

মরিচ চারা


জাত পরিচিতিঃ

সাধারণত মরিচকে দু ভাগে ভাগ করা যায় যেমন ঝাল মরিচ ও মিষ্টি মরিচ। বাংলাদেশে সবথেকে বেশি ঝাল মরিচ ব্যবহৃত হয়ে হয়। ঝাল মরিচের জাত গুলো হলো নাগা মরিচ, বগুড়ার মরিচ, বিজলী মরিচ, চাঁদপুরী,ফরিদপুরী, সহ ইত্যাদি জাত রয়েছে।

এছাড়াও আঞ্চলিক মৌসুমি জাত গুলো হলো কামরাংগা, আকালী, কালো মরিচ, জিয়া মরিচ ইত্যাদি। আঞ্চলিক ভাবে আরো কিছু জাত রয়েছে যেমন মেজর, যমুনা, বালিঝুরা মরিচ, সাহেব মরিচ, বোম্বাই মরিচ, ধানী মরিচ, পাটনাই, গোল মরিচ, বারি মরিচের ৩ টি জাত রয়েছে।


মরিচের বীজতলাঃ

মরিচের বীজ সরাসরি জমিতে বপন করা যায়না যার জন্য বীজ তলা তৈরি করে নিতে হয়। বীজ তলা তৈরির জন্য আদর্শ মাপ হলো ৩ মিটার লম্বা ও ১ মিটার চওড়া। তবে বীজতলায় চারার সংখ্যা উপর নির্ভর করে মাপ কম বেশি হতে পারে।

গ্রীস্মকালীন বীজতলার উচ্চতা ১৫ সেঃমি এর বেশি নয় এবং শীতকালীন বীজতলার জন্য ৭-৮ সেঃ মিঃ হতে হবে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থার জন্য গ্রীস্মকালীন বীজতলার উচ্চতা বেশি থাকে।


বীজ শোধনঃ

জমিতে বা বীজতলায় বীজ বপনের আগে মরিচের বীজ শোধন করে নিতে হয়। বীজ শোধন করে নিলে চারা অবস্থায় রোগ বালাই কম হয়ে থাকে। প্রোভেক্স জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হয়।

নীরোগ চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপনের আগে প্রতি কেজি বীজের সাথে ২ গ্রাম প্রোভেক্স ২০০ দ্বারা ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে তারপর ১০-১৫ মিনিট ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে শুকিয়ে নিতে হবে।


বীজ বপনঃ

১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে, তারপর বীজ থেকে পানি ঝরিয়ে হালকা ছায়াতে শুকিয়ে ঝরঝরা করে বীজতলায় ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হলো বর্ষা মৌসুমের জন্য মার্চ – এপ্রিল মাস এবং রবি মৌসুমের জন্য অক্টোবর-নভেম্বর মাস।

মিষ্টি মরিচ রবি মৌসুমেই ভালে জন্মে আর ঝাল মরিচ বছরের সবসময়ই জন্মে থাকে। বপনের সময় মনে রাখতে হবে বীজ কোনো ক্রমেই যেন ১-১.৫ সে.মি এর বেশি মাটির গভীরে না যায়। মরিচের বীজ সরাসরি বপন করলে ১৫-২০ সে.মি. পরপর গাছ রেখে পাতলা করে দিতে হবে।



মরিচের চারা তৈরি ও রোপনঃ

বীজতলায় চারা যখন ১০ সে মি লম্বা হয় তখন চারা মুল জমিতে রোপণের উপযোগী হয়। মরিচ ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কারের পরে ৩-৪ টি চাষ এবং মই দিয়ে জমি প্রস্তুতি করে চারা রোপন করতে হয়।

মরিচের চারা রোপণের সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০-৭০ সে.মি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০-৪০ সে.মি রাখতে হবে। মরিচের চারা বিকালে লাগাতে হবে এবং ৩-৪ দিন সকাল সন্ধ্যা পানি দিতে হবে।


সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ

মরিচের চারা রোপনের ২০-২৫ দিন পূর্বে গোরব, সার মাটির সাতে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে প্রতি হেক্টরে গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ২৫০ কেজি, টিএসপি ২০০ কেজি এবং এমওপি সার ১৫০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।

জমি তৈরির সময় টিএসপি, গোবর এবং এমওপি সার ৫০ কেজি প্রয়োগ করা হয়। মরিচের চারা রোপনের ২৫ দিন পর ৮৫ কেজি ইউরিয়া ৩৫ কেজি এমওপি সার প্রথম উপরি প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর ৫০ দিন পর দ্বিতীয় ৭০ দিন পর তৃতীয় বার সার প্রয়োগ করতে হবে।


মরিচ গাছের সেচ ও পরিচর্যাঃ

চারা লাগানোর পরে হালকা পানির সেচ দিলে চারা সহজেই সতেজ হয়। গ্রীষ্মকালে জমিতে ৪-৫ দিন পরপর এবং শীতকালে ১০-১২ দিন পরপর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষেতের মাটির রস কমে গেলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিবার সার প্রয়োগের পরে সেচ দেয়া প্রয়োজন। সেচের কয়েক দিন পর মাটিতে চটা ধরে। মাটি চটা ভেঙ্গে দিতে হয় যাতে করে শিকড় প্রয়োজনীয় বাতাস পায় এবং গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সময়মত নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার ও মাটি ঝুরঝুরা করতে হবে।


মরিচ গাছের রোগ- বালাই ও প্রতিকারঃ

সাধারণত মরিচের রোগগুলোর জন্য দায়ী মাটি ও বীজের মধ্যে থাকা বিভিন্ন রকমের জীবাণু। রোগগুলো যেমন- ড্যাম্পিং অফ, গোড়া পচা, মূল পচা। এ রোগগুলো সচারাচর চারা অবস্থাতেই হয়ে থাকে।

উপরোক্ত রোগগুলো পিথিয়াম ও রাইজোকটোনিয়া নামক ছত্রাকের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। বীজতলায় বীজ বপনের পরপরই বীজ পচে যেতে পারে। অথবা চারা গজানোর পর চারা গাছ ফ্যাকাশে, দুর্বল ও লিকলিকে হয়। ছোট অবস্থায় চারার গোড়ায় পানিভেজা দাগ পড়ে ও চারা ঢলে পড়ে এবং মারা যায়। এ রোগ থেকে রক্ষার উপায় হলো: মরিচের বীজ শোধন করে নিতে হবে।

মরিচের ক্ষেতে মাইট ও থ্রিপসের আক্রমন দেখা যায়। প্রতিকারের জন্য ম্যালাথিয়ন/ মেটাসিসটক্স প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করলে এ সকল পোকা দমন করা যায়।

মরিচ গাছে এ্যানথ্যাকনোজ রোগের লক্ষন দেখা দিলে টিল্ট নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাতে ২ গ্রাম মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। সাদা মাছি ভাইরাস রোগ বিস্তারে সহায়তা করে থাকে, সাদা মাছি দমনের জন্য ডায়াজিনন প্রতি লিটার পানির সাথে ৩ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়।


ফসল সংগ্রহঃ

মরিচ গাছের ফুল আসার পর ১৫-২০ দিরে মধ্যে কাঁচা মরিচ তোলা হয়। তবে মরি্চের রং লাল হলে সেটিকে তুলে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। প্রতি হেক্টর ফলনে কাঁচা মরিচ ১০-১১ টন হতে পারে এবং শুকনো মরিচ ১.৫-২.০ টন হয়ে থাকে।


বীজ উৎপাদনঃ

খুব সহজেই মরিচ চাষীগণ বীজ উৎপাদন করতে পারে। বীজ উৎপাদনের সময় খেয়াল রাখতে হবে, যে জাতের মরিচ চাষ করবেন তার চারপাশে অন্তত ১৩০০ ফুটের মধ্যে, অন্য জাতের মরিচের গাছ যেন না থাকে।

মরিচ যখন পুষ্ট, পরিপক্ক, এবং উজ্জ্বল লাল রং- এর মরিচ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। একটি মরিচ থেকে ৭০ থেকে ৭৫ টি বীজ পাওয়া যায়। ১০০০টি বীজের ওজন হয় ৫ গ্রাম, একর প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ কেজি বীজ উৎপাদন করা সম্ভব।


বীজ সংরক্ষণঃ

ফসল তুলার পরে মরিচ চিরে বীজ বের করতে হবে। বীজ শুকানোর পর ঠান্ডা করে বায়ু নিরদ পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। যেমন প্লাস্টিকের কৌটা অথবা কাচের পাত্র ইত্যাদি।

একজন চাষী যদি সঠিকভাবে আধুনিক উপায়ে মরিচ চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে, তাহলে সহজেই লাভবান হতে পারবে।

No comments:

Theme images by merrymoonmary. Powered by Blogger.